করোনা মোকাবেলায় অদম্য যশোরের ‘পড়শি’
পড়শির স্বেচ্ছাসেবক দল
সীমান্তবর্তী জেলা যশোরের গ্রামগুলোতে করোনা সংক্রমণ মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। করোনা উপস্বর্গ নিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো গ্রামে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। এমনই একটি গ্রাম যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার নাভারণ ইউনিয়নের আমিনী। গত ২৪ জুলাই করোনা উপস্বর্গ নিয়ে গ্রামটিতে শামসুজ্জামান নামে পঞ্চাশোর্ধ একজন মারা যান। এ পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা সৃষ্টি, মাস্ক বিতরণ, অক্সিজেন সরবরাহ, চিকিৎসা, খাদ্য সহায়তাসহ নানা উদ্যোগ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় ‘পড়শি’ নামক একটি সংগঠনের তরুণ সদস্যরা। সংগঠনটির প্রায় ৫০ জন তরুণ স্বেচ্ছাশ্রম ও নিজেদের অর্থে রাত-দিন একাকার করে কাজ করে যাচ্ছেন।
করোনা উপসর্গদের প্রয়োজনীয় ঔষধ ও অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে
সচেতনতা বাড়াতে মাইকে করোনায় আক্রান্ত হলে করণীয় সম্পর্কে বার্তা প্রচার ও লিফলেট বিতরণ করছেন। গ্রামে কেউ যাতে মাস্ক ছাড়া প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য জনসাধারণের চলাচল নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। মাস্ক ছাড়া কাউকে গ্রামে প্রবেশ করতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক উপহার দেওয়া হচ্ছে। সবাই যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন সে বিষয়ে তদারকি করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে জীবাণুনাশক স্প্রে করেছেন তারা।
করোনা উপসর্গ আছে এমন ব্যক্তিদের অক্সিজেন লেভেল পরীক্ষা করা হচ্ছে
তারা আরও জানান, চায়ের দোকানে আড্ডা বন্ধ করতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। স্বাস্থবিধি মেনে করোনার তীব্র উপসর্গ বহন করা ব্যক্তিদের নিয়মিত জ্বর ও অক্সিজেন লেভেল পরীক্ষা করা হচ্ছে। কেউ অসুস্থ হলে জাতীয় হেল্প লাইনে কথা বলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। কারও অক্সিজেনের সমস্যা হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহ করা যায় এ জন্য তারা একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে সংরক্ষণে রেখেছেন। এছাড়া রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে যেন দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে জন্য সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্স চালক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সংগঠনটির সদস্য ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য ইমরান হোসেন বলেন, ‘সামাজিক ও নাগরিক দায়িত্ব থেকে আমরা গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। মহামরি করোনা মোকাবেলায় গ্রামের মানুষকে নানাভাবে সচেতন করা এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হচ্ছে। আমাদের উদ্দেশ্য গ্রামের মানুষকে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন এবং তাদের পরিবারকে সুরক্ষিত করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। গ্রামের কেউ যেন বিনা চিকিংসায় মারা না যান কিংবা অপচিকিংসার স্বীকার না হন, সেদিকে খেয়াল রাখা।’
সংগঠনের আরেক সদস্য স্কয়ার টয়লেট্রিজের সিনিয়র বিপণন কর্মকর্তা জাহিদ আল ইমরান বলেন, ‘শুধু করোনা নয়, জাতীয় যেকোনো দুর্যোগে গ্রামের মানুষের পাশে থেকে তাদের বিপর্যয় রোধে প্রস্তুত করা এবং বিপদে সাহস জোগানো আমাদের লক্ষ্য।’
করোনায় উপস্বর্গে মারা যাওয়া শামসুজ্জামানের ভাইপো ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী উসমান গণি বলেন, ‘জ্বর-সর্দি-কাশি-শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত চাচাকে নিয়ে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছানোর আগেই তিনি মারা যান। গ্রামে ঘরে ঘরে করোনার উপসর্গ। ‘পড়শি’র সদস্যরা প্রতিদিন অসুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ওষুধ বিতরণ করছেন। হেল্প লাইনে কথা বলে ওষুধ পরিবর্তন করে দিচ্ছেন। পাশাপশি সচেতনতামূলক সব ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষের মাঝ থেকে করোনা ভীতি দূর করতে তারা অনেকটা সফল হয়েছেন। এটা ভালো উদ্যোগ।’
প্রায় এক হাজার মানুষের আমিনী গ্রামে ২০১০ সালে কিছু শিক্ষিত যুবকের উদ্যোগে গড়ে ওঠে সামাজিক ও
অরাজনৈতিক সংগঠন ‘পড়শি’। বিপদে-আপদে গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে ‘তুমি আমি দুই ঘর, সুখে দুঃখে পরস্পর’—এই স্লোগানে সংগঠনটি গড়ে ওঠে।
সংগঠনটির আরও কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখায় আর্থিক সহযোগিতা করা, শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধে পিতামাতাকে সচেতন করা, স্কুল ও কলেজে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নত ফলাফলের জন্য কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের সহযোগিতা করা, অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসায় আর্থিক সহযোগিতা, গরিব পরিবারের মেয়েদের বিবাহে আর্থিক সহযোগিতা, বাল্য বিবাহ রোধ করা, দুর্যোগ মোকাবেলা সহযোগিতা, রমজানে গ্রামের মানুষের জন্য ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা, অসচ্ছলদের মধ্যে ঈদের আগের দিন সেমাই-চিনি বিতরণ, মাদকাসক্ত যুবকদের কাউন্সেলিং, দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ ইত্যাদি।




No comments